বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান ‘ইভ্যালি’ আসলে দারুণ এক বিজনেস আইডিয়া।
সাম্প্রতিক সময়ের তুমুল আলোচিত ইকমার্স প্রতিষ্ঠান ‘ইভ্যালি’ নিয়ে গত কয়েক দিনের বিস্তর আলোচনা, বিতর্ক, বিশ্লেষণ আর গবেষণার সারবস্তু পাঠ করে এবং বর্তমান দুনিয়ায় ইকমার্স উদ্যোগ, আইডিয়া, সাফল্য-ব্যর্থতা, ভবিষ্যত ইত্যাদি সংক্রান্ত নানা তথ্যপুঞ্জি গুগল করে যা বুঝলাম, বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান ‘ইভ্যালি’ আসলে দারুণ এক বিজনেস আইডিয়া।
গত কয়েক বছরে নানা প্রকারের সম্পূর্ণ ব্যর্থ, আংশিক ব্যর্থ ও মোটামুটি ব্যর্থ স্টার্টআপের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে যুক্ত থাকার অভিজ্ঞতা থেকে এবং চেনাজানা ব্যর্থ ও সফল উদ্যোক্তাদের সঙ্গে অভিজ্ঞতা বিনিময়ের সূত্র ধরে কেবল এটাই মনে হচ্ছে, ‘ইভ্যালি’-র উদ্যোক্তা জনাব মোহাম্মদ রাসেল একজন মেধাবী এবং সৃজনশীল ব্যক্তি। রাষ্ট্রীয় সাহায্য-সহযোগিতা পেলে ইনি তার ইভ্যালি ও অন্যান্য উদ্যোগগুলো আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার সক্ষমতা রাখেন।
দৈনিক প্রথম আলো নামক পত্রিকায় সম্প্রতি ‘ইভ্যালি’ নিয়ে যে বিশাল প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে, সেটি প্রকৃতপক্ষে একটি ধারণামূলক ও ভাসা-ভাসা ধরনের প্রতিবেদন। ‘ইভ্যালি’ ঠিক কীভাবে শেষ পর্যন্ত মানুষকে ঠকাচ্ছে বা ঠকাবে, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য বা প্রমাণ সেখানে নেই। আমি ব্যক্তিগতভাবে আস্থা ও শ্রদ্ধা পোষণ করি, এমন বহু মানুষ সেই প্রতিবেদনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে আছেন। তারা বা অন্য কেউ যদি দয়া করে আমাকে একটু আলোকিত করেন যে ওই প্রতিবেদনে কেন সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য-প্রমাণ নেই এবং কেন সেটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয়, তাহলে কৃতার্থ হবো। ওই প্রতিবেদনে যেসব মান্যবর বিশেষজ্ঞ ব্যক্তির মন্তব্য নেওয়া হয়েছে, তারাও সুনির্দিষ্ট কোনো কথা বলেননি। তারা বরং বলেছেন, ইভ্যালির মাধ্যমে অমুক আশংকা আছে, তমুক আশংকা আছে অথবা অতীতের অমুক দুষ্কর্মের সঙ্গে মিল আছে। কিন্তু গত কয়েক বছরে ‘ইভ্যালি’-র কর্মকাণ্ড ও উত্থান বিশ্লেষণ করে সুনির্দিষ্ট পয়েন্টে কথা বললে, তাদের বক্তব্যে বরং আস্থা পাওয়া যেত।
গত কয়েক বছরে নিয়মিত টেলিভিশনে টক শো হোস্ট করার অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, যেসব পেশাজীবী নিয়মিত গণমাধ্যমে বক্তব্য, মতামত ও অভিমত দেন, তাদের বড় অংশই কিন্তু বিষয়বস্তুর গভীরে না গিয়ে ভাসা ভাসা ধরনের বক্তব্য দিয়ে থাকেন। প্রতিবেদক বা উপস্থাপক কী অ্যাপ্রোচে প্রশ্ন করছেন, তার সঙ্গে তাল মিলিয়েই তাদের জবাবগুলো তৈরি হয়। সুনির্দিষ্ট পয়েন্টে কথা বলেন খুব অল্প মানুষ। ইভ্যালির ক্ষেত্রেও এখন পর্যন্ত একজনকে পেলাম না, যিনি স্পেসিফিক পয়েন্ট ধরে কথা বলছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও যারা ঝড় তুলছেন, সার্চ দিয়ে চেনা-অচেনা এমন অনেকের লেখাও খুঁজে বের করে পড়লাম, কারও বক্তব্যেই সুনির্দিষ্ট কিছু নেই, সবাই বলছেন অনুমানের ভিত্তিতে অথবা অন্য কারও বক্তব্য উদ্ধৃত করছেন।
খবরে দেখলাম, ‘ইভ্যালি’ ও এর উদ্যোক্তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও অন্যান্য কর্তৃপক্ষ এখন তদন্ত করে দেখবে, ‘ইভ্যালি’ তলে তলে আসলে কী করছে বা কী পরিকল্পনা আঁটছে। এই উদ্যোগ অতি অবশ্যই স্বাগত জানাই। তদন্ত শেষ হলেও ‘ইভ্যালি’ ও এর সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের ভবিষ্যতেও কঠোর নজরদারির মধ্যে রাখার বিকল্প নেই। তদন্তে নিষ্কলুষ প্রমাণিত হলে এবং কঠোর নজরদারির মধ্যে ইভ্যালিকে কার্যক্রম পরিচালনা করতে দিলে, সাধারণ ক্রেতাদের আস্থাও এক লাফে আকাশে উঠে যাবে। আর মোহাম্মদ রাসেলকে অনলাইনে যতখানি জানতে পারলাম এবং তার কয়েকটি ফেসবুক লাইভের বক্তব্য অনুসরণ করে যতটুকু বুঝলাম, ইনি উচ্চ মানের এলেমদার মানুষ। নিজের উদ্যম ধরে রাখতে পারলে, তিনি তার স্টার্টআপ বিশ্ব পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার যোগ্যতা রাখেন।
আমরা ছাপোষা ও মেধাহীন বাঙালিরা নিজেরা কিছু করে দেখানোর মুরোদ অল্প। আশেপাশের কেউ হঠাৎ অভিনব আর অনন্য-সাধারণ কিছু করে দেখিয়ে অন্য সবার চেয়ে ওপরে উঠে গেলে, আমরা প্রথম চোটে বিশ্বাসই করি না, প্রবল সন্দেহ নিয়ে চোখ সরু করে তাকাই, পরে যদি দেখি ঘটনা সত্যি, তখন তাকে টেনে-হিঁচড়ে মাটিতে নামিয়ে আনার জন্য উঠে পড়ে লেগে যাই। এই বিষয়ে আমাদের জাতিগত দক্ষতা ও সক্ষমতা ঈর্ষণীয় পর্যায়ের।
আমি ব্যক্তিগতভাবে ‘দারাজ’ থেকে নিয়মিত নানা বস্তু ক্রয় করে থাকলেও, ‘ইভ্যালি’ থেকে আজ পর্যন্ত কিছু কেনা হয়নি। তাদের মোবাইল অ্যাপ ডাউনলোড করি নাই। এমনকি তাদের ওয়েবসাইটেও মাত্র একবার ভিজিট করেছি। কয়দিন আগে কে একজন ‘ইভ্যালি’ থেকে কী কী জানি কেনার কথা ভাবছে শুনে কড়া গলায় তাকে সতর্ক করে বলেছি, এইসব দুই নম্বরী আর সন্দেহজনক ইকমার্স থেকে ভুলেও যেন কিছু না কেনে। এরা নিশ্চিতভাবেই একদিন মানুষের টাকা নিয়ে ভেগে যাবে।
অতীতের বহু খাঁটি দুই নম্বরী আর সন্দেহজনক প্রতিষ্ঠানের দুষ্কর্মের অভিজ্ঞতা থেকে সেদিন ওই কথাগুলো বলেছিলাম। এখনও যারা ‘ইভ্যালি’-কে প্রতারক প্রতিষ্ঠান আখ্যায়িত করছেন, তারা হয়তো সেই পূর্বধারণা থেকেই করছেন। গত কয়েক দিন ধরে ‘ইভ্যালি’ হঠাৎ আলোচনায় চলে আসার পর, অনলাইনে এ সংক্রান্ত নানা আলোচনা, বিশ্লেষণ, গবেষণা, যুক্তিতর্ক, অভিযোগ, সন্দেহ ইত্যাদি পর্যালোচনা করে সেই ব্যক্তিগত ধারণা থেকে আমি অনেকখানি সরে এসেছি।
যা বুঝলাম, ইভ্যালির বিজনেস মডেলটা আমাদের চেনাজানা ব্যবসা সংক্রান্ত ধ্যান-ধারণার সঙ্গে একেবারেই সাদৃশ্যপূর্ণ নয়। গণমাধ্যমের মান্যবর ‘বিশেষজ্ঞ’ প্যানেল এবং অভিজ্ঞ ব্যবসায়ীরা সেই বিষয়টি ধরতে পারছেন না বলেই বোধহয় ‘ইভ্যালি’-র ঝুঁকি, সম্ভাব্য প্রতারণা নিয়ে সুনির্দিষ্ট পয়েন্টে কিছু না বলে অনুমানমূলক কথাবার্তা বলে যাচ্ছেন।
আমাদের আলোচ্য ‘ইভ্যালি’ যেন মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করতে না পারে, সেটি নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের দায়িত্বশীল বিভিন্ন সংস্থার। দৈনিক প্রথম আলোকে ধন্যবাদ দিতে হয়, তাদের আগাম ‘অনুমানমূলক’ প্রতিবেদনের কারণে সেই সংস্থাগুলো ছোটখাটো ঝাঁকুনি খেয়ে নড়েচড়ে বসেছে এবং তারপর ‘ইভ্যালি’-কে ধরেও এখন ততোধিক ঝাঁকুনি দিচ্ছে। আমার ধারণা, এইবেলা তারা যদি কোনোমতে টিকে যায়, তাহলে তারা নিশ্চয়ই জন্মের মতো সোজা হয়ে যাবে এবং মনে মনে একটু-আধটু টাল্ডি-বাল্ডি করার দুরভিসন্ধি থাকলেও, সেই পরিকল্পনা থেকে সরে আসবে। ‘ইভ্যালি’ ভেতরে ভেতরে ছদ্মবেশী দুই নম্বরী প্রতিষ্ঠান হয়ে থাকলে, ডেসটিনি কোম্পানির মতো ভবিষ্যতে লোকজনকে বড় ধরনের ধরা খাওয়ানোর যে ঝুঁকি ছিল, বর্তমান তৎপরতায় সেই ঝুঁকিও নস্যাৎ হওয়া উচিত।
একবার নিষ্কলুষ সার্টিফিকেট পেয়ে গেছে ‘ইভ্যালি’ সম্ভবত অন্য ইকমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর ধরা-ছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে। একটা প্রতিষ্ঠান যাত্রা শুরু করার পর দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিপুল গ্রাহকগোষ্ঠী তৈরি করার জন্য যা যা করার দরকার, ‘ইভ্যালি’ তা-ই তা-ই করেছে। একবার মার্কেট লিডার হয়ে উঠতে পারলে, তারা এইসব আজগুবি অফার টফার দেওয়াও বন্ধ করে দিত কিনা কে জানে। তবে ‘ইভ্যালি’-র কারণে অন্য আর দশটা সম্ভাবনাময় ইকমার্স উদ্যোগ যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেটা নিশ্চিত করতে হলে সঠিক ব্যবসা-বান্ধব নীতিমালা ও সাম্য-সহায়ক পরিবেশ দরকার হবে। সেটি সরকারের দায়িত্ব। টেলিযোগাযোগ খাতে দৈত্য হয়ে ওঠা গ্রামীণফোনকে অন্যদের লেভেলে নিয়ে আসার জন্য সে ধরনের উদ্যোগ আমরা সাম্প্রতিক সময়ে প্রত্যক্ষ করেছি।
যাহোক, ‘ইভ্যালি’-র কনসেপ্টটা পছন্দ হয়েছে। সবচেয়ে বেশি পছন্দ হয়েছে এর উদ্যোক্তা মোহাম্মদ রাসেলকে। তার কর্মকাণ্ড স্ট্যাডি করেও অনেক কিছু শিখলাম। তিনি ও তার পরিকল্পনা পুরোপুরি নিষ্কলুষ, এখন পর্যন্ত এই ধারণাটাই পোষণ করে রাখছি। সেই পয়েন্ট থেকে আপাতত ‘ইভ্যালি’-র জন্য শুভকামনা। কেন্দ্রীয় ব্যাংক, দুর্নীতি দমন কমিশন, প্রতিযোগিতা কমিশন ও অন্যান্য সংস্থার কঠিন কঠিন তদন্ত শেষে ‘ইভ্যালি’ নির্দোষ প্রমাণিত হোক, সেই প্রত্যাশাটাও রেখে দিচ্ছি। ‘ইভ্যালি’ সত্যি সত্যি ভয়ংকর কোনো প্রতিষ্ঠান কিনা, সেটাও জানতে আগ্রহী। ভাসা-ভাসা আর অনুমাননির্ভর বক্তব্য নয়, সুনির্দিষ্ট ও যুক্তিযুক্ত আলোচনায় কেউ যদি আলোকিত করতে পারেন, তাহলে কৃতজ্ঞ হই।
সম্পূর্ণ লেখাটি ATN News এর Editor Nauroz Imtiaz ফেসবুক আইডি থেকে সংগ্রহীত।