Evaly Fan's Club

হাওয়ায় ব্যবসা – হাওয়াই মিঠাই নাকি শাওমি

হাওয়ায় ব্যবসা – হাওয়াই মিঠাই নাকি শাওমি

হাওয়ার উপর চলে গাড়ি, লাগে না পেট্রোল-ডিজেল; মানুষ একটা দুই চাকার সাইকেল!

          কালনী পাড়ের মরমী সাধক আব্দুল করিমের গানের একান্ত অনুরাগী আমি। পল্লীগাঁয়ের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বঞ্চিত একজন মানুষ, গানে গানে সহজ কথায় কঠিন ভাবের আরাধনায় জীবন কাটিয়ে দিলেন।

গানে দেহযন্ত্রকে “হাওয়া গাড়ি” বলা হয়। মানবদেহের অন্যতম প্রয়োজনীয় উপাদান অক্সিজেন পাওয়া যায় হাওয়া মানে বাতাসে। তবু, শুধু অক্সিজেন এ চরণ চলে না, মধ্যে মধ্যে আটক হই। খাদ্য এবং পানীয় প্রয়োজন হয়।

সে যাকগে। কবিদের অতো-শত না ভাবলেও চলে! তাছাড়া আমি কে কবির কবিতায় বেড়ী পড়ানোর।

হাওয়ার ব্যবসাটা বাংগালীর ঐতিহ্যগত। ছোটবেলায় শিশুপার্কের সামনে হাইড্রোজেন হাওয়া ভরা বেলুন হাতে দাঁরিয়ে থাকা ফেরিওয়ালা কিংবা হাওয়াই মিঠাই ওয়ালা দুপক্ষই আমাকে ব্যাপক আকর্ষন করতো। হাওয়ার প্রতি এই টান এখনো মিইয়ে যায়নি মনে হয়।

সেই অমোঘ টান উপেক্ষা করতে না পেরেই হাওয়ার জগতে বিচরণ শুরু। আজ আমার গল্প বলবো না। বলবো আরেকদল হাওয়াচারী মানুষের গল্প। গল্পটা চীন দেশের। লোকে বলে, জ্ঞানার্জনের জন্য সদূর চীন দেশে যাওয়া উচিৎ। চীন যাওয়া না হলেও, ইন্টারনেটের হাওয়ায় ভেসে চীনের গল্প চলে আসে অতি সহজে। তেমনি এক গল্প বলবো আজ। কিছু চৈনিক স্বপ্নচারী মানুষের গল্প।

২০১০

স্মার্টফোন জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। আই ওএস এর সাথে বাজার দখলের লড়াই চলছে গুগলের মালিকানাধীন এন্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেমের। আরেক জায়ান্ট উইন্ডোজ চাচ্ছে নিজেদের ভাগ বুঝে নিতে।

“লিন বিন” তখন গুগলের চাইনিজ ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্সটিটিউটের ভাইস প্রেসিডেন্ট। চীনে জনপ্রিয় হচ্ছে উদ্যোক্তা কালচার। ঠিক এখনকার আমাদের বাংলাদেশের মতো রমরমে অবস্থা। চাইনিজ সরকারের নীতির কারনে বিদেশীরা এসে ঠিক সুবিধা করতে পারছিলো না। সুযোগ দেখতে পান লিন বিন। সফটওয়্যার ফার্ম বানানোর স্বপ্ন নিয়ে চাকরী ছেড়ে দিলেন।

পাশে পেলেন কিংসফটগুগলবাইদু এবং মটোরলার মতো জাঁদরেল প্রতিষ্ঠান ছেড়ে আসা আরো পাঁচজন স্বপ্ন সারথী। গড়ে তোলেন নিজেদের সফটওয়্যার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান শাওমি

এটা শাওমি ওয়েবসাইটের একটি স্ক্রিনশট। স্ক্রিনশটটি নেওয়া হয়েছিলো ২১ এপ্রিল ২০১০ এ। ভাষা ছিলো চাইনিজ, গুগল ট্রান্সলেট ব্যবহার করে ট্রান্সলেট করা।

চাইনিজ বাজারে “Driver’s Secret” নামের কার ওয়াশ এবং ট্রাফিক রিলেটেড এপ নিয়ে আসে তারা। ড্রাইভিং লাইসেন্স নাম্বার, গাড়ির লাইসেন্স নাম্বার, ইঞ্জিন নাম্বার আর ফাইল নাম্বার দিয়ে গাড়ির যেকোন মামলা এবং বিস্তারিত সকল তথ্য পাওয়া যেত। গাড়ি যেখানেই থাকুক না কেন, মেইনটেইন্যান্স চলে এসেছিলো হাতের মুঠোয়

সহজ সাবলীল ইন্টারফেস হওয়ায় খুব সহজেই ব্যবহারকারীদের পছন্দের তালিকায় চলে আসে তারা। একের পর এক নতুন নতুন শহর যোগ হচ্ছিল তাদের ডেটাবেইজ এ

শুরুটা বেশ ভালোই ছিলো। হংকং ভিত্তিক ভেঞ্চার ক্যাপিট্যাল ফার্ম মর্নিংসাইড এবং চাইনিজ ভেঞ্চার ক্যাপিট্যাল ফার্ম কিমিং এর বিনিয়োগে ভর দিয়ে পথচলা শুরু হয়।

অগাস্টের শুরুতে পরপর দুইটি এপ বাজারে আনে শাওমি। এম আই নোটস এরমধ্যে অন্যতম। ওয়েব, ডেস্কটপ এবং এন্ড্রয়েড এপ এই তিন মাধ্যমে ব্যবহার উপযোগী ছোট এপটির যাত্রা শুরু হয় অগাস্টের ৩ তারিখ।

অগাস্টের ৯ তারিখ বাজারে এলো এম আই শেয়ার নামের একটি পোর্টাল। এর আগে জুলাইয়ের ২৯ তারিখ এই এপটির বেটা লঞ্চ হয়েছিলো।

মোবাইল এবং কম্পিউটার সব ডিভাইসে ব্যবহার উপযোগী করে বানানো হয়েছিলো পোর্টালটি।

ওয়ালপেপার, রিংটোন, জোকস, এস এম এস ইত্যাদি আপলোড এবং ডাউনলোডের পাশাপাশি এক ডিভাইস থেকে আরেক ডিভাইসে ডেটা ট্রান্সফারের সুবিধা, সবই ছিলো।

MIUI এর আঁতুরঘর বলা চলে এম আই শেয়ার কে।

পয়লা অক্টোবর। যুগান্তকারী এক ঘোষনা আসে http://www.miui.com/ সাইটটিতে। শুধুমাত্র চীনা ব্যবহারকারীদের জন্য বাজারে আনা হয় MIUI নামক এন্ড্রয়েড ২.২ বেজড কাস্টম রম।

ঘোষনায় পরিষ্কার বলা হয় চাইনিজ ছাড়া অন্য কোন ভাষা নিয়ে ডেভলাপারদের কোন পরিকল্পনা নেই

এর পাশাপাশি আরো কিছু এপ বাজারে আনে শাওমি। মোর্দাকথা, শাওমি মনে প্রাণে একটি সফটওয়্যার ফার্ম হতে চেয়েছিলো। চেয়েছিলো হাওয়াও হাওয়ায় ব্যবসা চালিয়ে যাবে। সময়ের প্রয়োজনে সেটা সম্ভব হয়নি। সফটওয়্যারের পাশাপাশি হার্ডওয়্যার ব্যবসায় নাম লেখাতে বাধ্য হয় শাওমি। 

নিজেদের একটি হার্ডওয়্যার প্লাটফর্মের প্রয়োজনীয়তা জেঁকে বসে সবদিক থেকে। সিদ্ধান্ত হয় প্রায় বিনা লাভে হার্ডওয়্যার বিক্রির।সফটওয়্যার বান্ডেলের একটি অংশ হিসেবে প্রথম শাওমি মোবাইল বাজারে আসে ২০১১ তে।

২০১১

১৬ অগাস্ট, ২০১১, শাওমি এম ১ আসে চীনের বাজারে। দাম ধরা হয় ১৯৯৯ ইউয়ান বা প্রায় ১৬০০০ বাংলাদেশী টাকা। বাজারে আসার প্রথম ৩৪ ঘন্টার মধ্যে তিন লাখ প্রি-অর্ডার জমা হয়। যত্তোসব লোভী ক্রেতার দল!

এই পুরো বিক্রিবাট্টা হয় বাতাসে, মানে অনলাইনে। শাওমি কখনোই হার্ডওয়্যার ব্যাবসা করতে চায়নি। তারা সবসময় নিজেদের সফটওয়্যার নির্মাতা হিসেবে দাবী করে।

তাদের কাছে নিজেদের ফোনগুলো হলো সফটওয়্যার বিক্রি করার উপসর্গ। বাতাসে বিচরণই ছিলো তাদের মূল উদ্দ্যেশ্য।

যেহেতু এম আই ইউ আই তখনো চাইনিজ ছাড়া অন্য কোন ভাষা সাপোর্ট করতো না তাই চায়নার বাইরে কোথাও ফোন বিক্রি করা সম্ভব হয়নি। এমনকি হংকং, ম্যাকাও কিংবা তাইওয়ানেও শিপিং কতে পারেনি।

 

শাওমি কিভাবে সেকেন্ডে ২.৫ টি ফোন বিক্রি করলো?

এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রশ্ন। এ পর্যায়ে এসে আমরা বুঝতে চেষ্টা করবো কিভাবে হাওয়ায় ব্যবসা করতে হয় এবং শাওমি কিভাবে সফলভাবে হাওয়ায় ব্যবসা করতে সক্ষম হয়।

ন্যায্যমূল্য

শাওমি শুরু থেকে কখনোই হার্ডওয়্যার বিক্রি করে লাভ করতে চায়নি। তাই ফ্ল্যাগশিপ কোয়ালকম স্ন্যাপড্রাগন প্রসেসর এবং এক গিগাবাইট র‍্যাম দেওয়া সত্ত্বেও ফোনের দাম ছিলো টিনেজারদের হাতের নাগালে। নজরকাড়া ফিচার আর ন্যায্যমূল্য তরুণদের উন্মাদনাকে উষ্কে দিয়েছিলো।

ফোনের ন্যায্যমূল্য নির্ধারন করার জন্য লাভ কম রাখার পাশাপাশি আরো যে কাজগুলো শাওমি করে সেগুলো হলোঃ

বিজ্ঞাপন ব্যায় নিয়ন্ত্রণ

শাওমি ওয়ার্ড অফ মাউথ পলিসি গ্রহণ করেছিলো। আগে থেকেই বাজারে থাকা এম আই ইউ আই এর ফ্যান বেইজ অপেক্ষায় ছিলো শাওমি ফোন বাজারে আসার। শাওমির সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং পলিসি এক্ষেত্রে প্রসংশার দাবিদার। এভারেজ সোশ্যাল মিডিয়া এনগেজমেন্ট রেট আনুমানিক ৩০ শতাংশের আশেপাশে হলেও চাইনিজ সোশ্যাল মিডিয়া উইবোতে শাওমির এনগেজমেন্ট রেট ছিলো প্রায় দ্বিগুণ। গবেষণায় দেখা যায় যেকোন নতুন প্রযুক্তি বাজারে এলে টিনেজাররাই সবার আগে গ্রহণ করে নেয়। শাওমি চাইনিজ টিনেজারদের আচরণ বুঝে গেরিলা মার্কেটিং পলিসি এডপ্ট করে নেয়।

আমরা সবাই জানি বিজ্ঞাপন ব্যায় পণ্যের দামের সাথে যোগ করে বিক্রয়মূল্য নির্ধারন করা হয়। যেখানে খরচ নেই সেখানে সেটা যোগ করার প্রয়োজন নেই।

উৎপাদন এবং মজুদ ব্যায় নিয়ন্ত্রণ

শাওমি যেহেতু প্রি-অর্ডারের মাধ্যমে ফোন বিক্রি করেছিলো তাই প্রোডাকশনে যাওয়ার আগেই কতটুকু সময় এবং কাঁচামাল লাগবে তার হিসেব বের করা ছিলো সহজ। কাঁচামাল এনে অতিরিক্ত সময় সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা কমে আসে। সময় বাঁচে আর সময় মানেই তো টাকা। এছাড়া বাড়তি পণ্য উৎপাদন করে গুদামজাত করা লাগেনি তাই মজুদ ব্যায় ও হয় সীমিত।

শুধুমাত্র অনলাইনে বিক্রি

ব্রিক এন্ড মর্টার বিজনেসের সাথে রিয়েল এস্টেট জড়িত। এজন্য গুণতে হয় অনেকগুলো বাড়তি টাকা। শাওমি তাই সচেতনভাবেই অনলাইন ভিত্তিক অর্থাৎ হাওয়ায় ব্যবসা করতে মনোযোগ দেয়। শুধু রিয়েল এস্টেট না, অতিরিক্ত কর্মীবাহিনী, তাদের প্রশিক্ষণ ইত্যাদি নানা আনুষংগিক খরচ চলেই আসে। সেগুলো কিন্তু ক্রেতার কাছ থেকেই আদায় করা হয়।

শাওমি শুরু থেকেই গ্রাহকের স্বার্থের দিকে মনোযোগী। গ্রাহক না থাকলে হাওয়ায় ভেসে ভেসে টাকা আসে না সেটা অনেকে না বুঝলেও শাওমি বুঝে খুব ভালোভাবেই।

ক্রেতা চাহিদার মূল্যায়ন

শাওমির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা লেই জুন বলেন, কিংসফট এ থাকতে নোকিয়া এবং মটোরোলার মতো জায়ান্টদের সাথে কাজের সুযোগ পেয়েছি। যখনই এসব বড় বড় প্রতিষ্ঠানের রিসার্স এন্ড ডেভলাপমেন্ট বসদের সাথে নতুন কোন বিষয়ে কথা বলতে চেয়েছি, নতুন আইডিয়া শেয়ার করেছি, এরা এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করেছে। তখনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, নিজের প্রতিষ্ঠানে ক্রেতা চাহিদার মূল্যায়ন করবো সবার আগে।

শাওমির সোশ্যাল মিডিয়া এনগেজমেন্টের পয়েন্টটাতো আগেই বলেছি। এই দ্বিমুখী যোগাযোগ শাওমির সেরা পণ্য সৃষ্টির পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

কৃত্রিম ঘাটতি সৃষ্টি

শাওমির ফোন যে-কেউ চাইলেই কিনতে পারতো না। অগ্রিম টাকা জমা দিয়ে অপেক্ষা করা লাগতো। ক্রেতা যেহেতু চালেই ব্রিক এন্ড মর্টার শপ থেকে কিনে ফেলতে পারতো না তাই বাজারে সংকট লেগেই থাকতো। ফলে কারো পাওয়া উচ্ছাস অথবা কারো না পাওয়ার বিলাপ, যেকোন কারনেই হোক মুখে মুখে লেগেই থাকতো শাওমির কথা।

পাশাপাশি, শাওমি তাদের ফোনের স্পেশাল ভার্সন বাজারে আনে। যেটা প্রতিদিন মাত্র ২০০ কপি অর্ডার নিতো, ফ্ল্যাশ সেলের মাধ্যমে। মাত্র তিন দিনের জন্য, সকাল দশটায় এই এই ফ্ল্যাশ সেল চালু হতো। অর্ডারের আধাঘন্টার মধ্যে অনলাইনে পেমেন্ট না করলে অর্ডার বাতিল। আরো কিছু শর্ত, যেমন ফোরাম পয়েন্ট, ভেরিফিকেশন কোড ইত্যাদি ছিলো।

মোট কথা, “এই গেলো গেলো” ভাব আনার জন্য যা যা দরকার সবই ছিলো।

শেষ কথা

২০১১ এর ডিসেম্বর নাগাদ চাইনিজ সরকারি মোবাইল সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান চায়না ইউনিকম এর সাথে চুক্তি হয় শাওমির। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী পরবর্তী তিন বছরে দশ লক্ষ শাওমি এম ১ সরবরাহ করে শাওমি। এরপরের গল্পটা আমরা সবাই জানি।

আচ্ছা শাওমি তাহলে লাভ করে কিভাবে?

শাওমির লাভটা আসে MIUI চালিত ডিভাইসে বিজ্ঞাপন দেখিয়ে, ফোনের হেডফোন, স্পীকার, চার্জার এসব বিক্রি করে। আপাতদৃষ্টিতে শাওমি একটি মোবাইল ফোন নির্মাতা ব্র্যান্ড হলেও, শাওমি মূলত একটি ইকোসিস্টেম। শাওমি চায় না কেউ তাদের চীনের এপল বলুক। নিজেদের চীনের এমাজান হিসেবে দাবী করতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে শাওমি।

হাওয়ার ব্যবসায় লাভটা আজ বিক্রি করলে আজকেই আসবে না, এখানে বিক্রিটাও এক প্রকার ইনভেস্টমেন্ট।

আরো পড়ুনঃ 

Rate this post
Exit mobile version